দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম সরকারি ইসলামী ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু: আমানত সুরক্ষা ও খেলাপি ঋণের চ্যালেঞ্জ
দেশের আর্থিক খাতে গভীর স্থিতিশীলতার সংকট মোকাবিলায় এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপে পাঁচটি আর্থিকভাবে দুর্বল শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে গঠিত ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় ও সরকারি মালিকানাধীন এই ইসলামী ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু করতে আর কোনো বাধা রইল না।
রোববার, ৩০ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ বোর্ড সভায় এই চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
Table of Contents
কেন এই একীভূতকরণ?
এই বৃহৎ একীভূতকরণের মূল কারণ ছিল পাঁচটি শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চরম আর্থিক দুর্বলতা এবং আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক সংকটের চিত্র ভয়াবহ:
- আমানত ও আমানতকারীর সংখ্যা: এই ৫টি ব্যাংকে বর্তমানে ৭৫ লাখ আমানতকারীর ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা জমা রয়েছে।
- ঋণের পরিমাণ: এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা।
- খেলাপি ঋণের বিস্ফোরণ: এই ঋণের একটি বিশাল অংশ, প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৭৬ শতাংশ, খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে একীভূতকরণকে অপরিহার্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ব্যাংকগুলো একীভূত করা ছাড়া “বিকল্প ছিল না”। তিনি আরও প্রত্যাশা করেন যে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে এই প্রক্রিয়া থেকে “অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু হবে”।
মূলধন ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা
নতুন ব্যাংকটির যাত্রা শুরুর সাথে সাথে আর্থিক খাতে আস্থা ফেরাতে সরকার বিশাল মূলধন জোগান দিচ্ছে:
- মোট পরিশোধিত মূলধন: নতুন ব্যাংকটির মোট পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
- সরকারের অংশ: সরকার মোট ২০ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। প্রাথমিক মূলধন হিসেবে সরকার জোগান দিচ্ছে দশ হাজার কোটি টাকা।
- আমানতকারীদের শেয়ার: বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা আমানতকারীদের জমানো টাকার বিপরীতে শেয়ার হিসেবে দেওয়া হবে।
- অনুমোদিত মূলধন: প্রাথমিকভাবে এর অনুমোদিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং তারল্য প্রবাহ বাড়াতে সরকারি তহবিল এই নতুন ব্যাংকে রাখা হবে। পাশাপাশি আকর্ষণীয় মুনাফা দিয়ে সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ রাখতে উৎসাহিত করা হবে।
অর্থ ফেরত ও সুরক্ষা স্কিম
চূড়ান্ত অনুমোদনের পর আমানতকারীদের অর্থ ফেরত সংক্রান্ত স্কিম ঘোষণা করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে:
- ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ প্রদানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে।
- আমানতকারীরা শুরুতে আমানত বিমা তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করতে পারবেন।
- বাকি টাকা কোন উপায়ে, কী হারে মুনাফা দিয়ে এবং ধাপে ধাপে তোলা যাবে, তার বিস্তারিত স্কিম কর্মসূচি কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি সপ্তাহে ঘোষণা করতে পারে।
উল্লেখ্য, একীভূত হওয়ার আগে গত ৫ নভেম্বর আর্থিকভাবে দুর্বল এই পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংককে অকার্যকর ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিল।
নতুন ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামো
‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ এর কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে:
- কার্যক্রম শুরু: ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই নতুন ব্যাংকটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করবে।
- প্রধান কার্যালয়: ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের সেনা কল্যাণ ভবনে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলা হয়েছে।
- পরিচালনা পর্ষদ: পর্ষদ হবে সাত সদস্যের। বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। পর্ষদের অন্যান্য সদস্যরা হলেন সরকারি বিভিন্ন বিভাগীয় সচিব ও যুগ্ম সচিবরা।
- স্বতন্ত্র পরিচালক ও এমডি নিয়োগ: পেশাদার ব্যাংকার, হিসাববিদ এবং আইনজীবী সমানসংখ্যক স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগের জন্য সরকারের পরামর্শক্রমে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন করা হবে।
- শাখা সংকোচন: ব্যাংকগুলোর পরিচালন খরচ কমাতে একই এলাকার একাধিক শাখা একীভূত করে একটি বা দুটি করা হবে। সারা দেশে এসব ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে।
এই একীভূতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, ইসলামি ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।