দেশের আর্থিক খাতে আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং জনগণের আস্থা বৃদ্ধিকল্পে সরকার কর্তৃক ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়েছে। সংসদ ভেঙে যাওয়ার পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে এই অধ্যাদেশটি প্রণয়ন করেন। এই নতুন আইনটি ‘ব্যাংক আমানত বিমা আইন, ২০০০’ রহিত করে একটি যুগোপযোগী কাঠামো কার্যকর করেছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নতুন আইন কার্যকর হওয়ার ফলে দেশের আর্থিক খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও সংকট মোকাবেলার সক্ষমতা বাড়বে এবং আমানতকারীরা আরও বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবে সুবিধা পাবেন।
Table of Contents
১. আইনের মূল উদ্দেশ্য এবং আওতা
আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশের প্রধান উদ্দেশ্য হলো ব্যাংক কোম্পানি এবং ফাইন্যান্স কোম্পানিতে আমানত রাখা ব্যক্তিদের সুরক্ষিত আমানত ফেরত নিশ্চিত করা।
সদস্য প্রতিষ্ঠানসমূহ (Member Institutions)
বিদ্যমান সকল ব্যাংক কোম্পানি এই আইনের অধীনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সদস্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যদিকে, ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো ২০২৮ সালের ১ জুলাই থেকে সদস্যপদে অন্তর্ভুক্ত হবে।
‘ব্যাংক কোম্পানি’ বলতে Bangladesh Bank Order, 1972 (P.O. No. 127 of 1972) এর section 2 এর দফা (j) এর অধীন সংজ্ঞায়িত তফসিলি ব্যাংককে বোঝানো হয়েছে।
তহবিল ও প্রশাসন
সুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের (Bangladesh Bank Order. 1972 এর অধীন প্রতিষ্ঠিত) আওতায় একটি পৃথক আমানত সুরক্ষা বিভাগ গঠন করা হবে। এই বিভাগ নিয়মিতভাবে প্রিমিয়াম সংগ্রহ, তহবিল ব্যবস্থাপনা, সদস্য প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, আমানত পরিশোধ এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
নতুন আইনে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানির জন্য দুটি স্বতন্ত্র আমানত সুরক্ষা তহবিল গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। এই তহবিলগুলো সদস্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত প্রারম্ভিক প্রিমিয়াম, ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঝুঁকি-ভিত্তিক প্রিমিয়াম, জরিমানা, বিনিয়োগ আয় এবং অন্যান্য অনুমোদিত উৎস থেকে পরিচালিত হবে। তহবিলের প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, যা ‘ট্রাস্টি বোর্ড’ হিসেবে বিবেচিত হবে। পূর্বের আমানত বীমা ট্রাস্ট তহবিলে জমাকৃত সকল অর্থ আমানত সুরক্ষা তহবিলে (ব্যাংক কোম্পানি) স্থানান্তরিত হবে।
২. সুরক্ষিত আমানতের সীমা ও পরিশোধ প্রক্রিয়া
আমানতকারীদের জন্য এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সুরক্ষিত আমানতের সীমা এবং তা পরিশোধের প্রক্রিয়া।
সুরক্ষিত আমানতের সর্বোচ্চ সীমা
প্রত্যেক সদস্য প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক আমানতকারীর জন্য সুরক্ষিত আমানতের সর্বোচ্চ সীমা হবে ২ (দুই) লক্ষ টাকা।
গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো:
- কোনো আমানতকারীর যদি একাধিক হিসাব থাকে, তবে সবগুলো যোগ করে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত সুরক্ষা হিসাব করা হবে।
- সরকার, ট্রাস্টি বোর্ডের সুপারিশক্রমে, প্রতি ৩ (তিন) বৎসরে অন্যূন একবার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, এই সর্বোচ্চ সীমা পুনঃনির্ধারণ করবে।
পরিশোধ প্রক্রিয়া
কোনো সদস্য প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের (liquidation) তারিখে প্রত্যেক সুরক্ষিত আমানতকারীর সুরক্ষিত আমানতের পরিমাণ নির্ধারিত হবে। ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানির অবসায়ন বা রেজল্যুশনের ক্ষেত্রে আমানত সুরক্ষা বিভাগ সরাসরি সুরক্ষিত আমানত পরিশোধ করবে।
যদি আমানতের পরিমাণ ২ লাখ টাকার বেশি হয়:
- নতুন আইন অনুসারে, প্রথমে আমানত সুরক্ষা তহবিল থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
- এর বেশি আমানত থাকলে গ্রাহককে অবসায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি উত্থাপন করতে হবে।
- প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ বিক্রয় বা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার (রেজল্যুশন) মাধ্যমে অতিরিক্ত অংশ ধাপে ধাপে (পর্যায়ক্রমে) ফেরতের ব্যবস্থা করা হবে।
রেজল্যুশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, প্রয়োজনে রেজল্যুশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্রিজ ব্যাংক (যা ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর ধারা ৩ এর দফা (৩৪) এ সংজ্ঞায়িত) অথবা তৃতীয় পক্ষের কাছে সম্পদ হস্তান্তর ও আমানত সুরক্ষা প্রক্রিয়াও পরিচালিত হতে পারে। ‘রেজল্যুশন’ অর্থ ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ (২০২৫ সনের ১৯ নং অধ্যাদেশ) এর ধারা ৩ এর দফা (৩৭) এ সংজ্ঞায়িত রেজল্যুশন।
৩. সুরক্ষা বহির্ভূত আমানত (Exempted Deposits)
অধ্যাদেশে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির আমানতকে ‘সুরক্ষা বহির্ভূত আমানত’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর অর্থ হলো, এই আমানতগুলো এই আইনের অধীনে সুরক্ষিত হবে না।
সুরক্ষা বহির্ভূত আমানতগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- সরকারি আমানত: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৫(৬) অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত Rules of Business, 1996 এর Schedule-I (Allocation of Business among the Different Ministries and Divisions) এর অধীন প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং সেগুলোর আওতাধীন দপ্তর ও সংস্থার আমানত।
- সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আমানত।
- রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, স্ব-শাসিত সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আমানত: এগুলি সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৫৭ নং আইন) এর ধারা ২ এর দফা (১১), (১৮) ও (১৯) এ সংজ্ঞায়িত।
- বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার আমানত।
সাধারণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আমানত, যা উপরোক্ত তালিকায় নেই, সেগুলো ‘সুরক্ষাযোগ্য’ হিসেবে গণ্য হবে এবং নির্ধারিত সীমার মধ্যে সুরক্ষিত থাকবে।
৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অন্যান্য বিধান
বাংলাদেশ ব্যাংককে এই আইনের অধীনে দেশি-বিদেশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে সমঝোতা স্মারক সই, তথ্য বিনিময়, কারিগরি সহযোগিতা গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে আমানত সুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, এই অধ্যাদেশ প্রবর্তনের পর, সরকার সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, এই অধ্যাদেশের মূল বাংলা পাঠের ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ (Authentic English Text) প্রকাশ করতে পারবে।
উপসংহার
‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ দেশের আর্থিক ব্যবস্থায় একটি মজবুত ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ২ লাখ টাকার সীমা নির্ধারণ এবং একটি সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অপ্রত্যাশিত সংকটের সময় আমানতকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করবে। যদিও বৃহত্তর আমানতকারীদের জন্য এটি আংশিক সুরক্ষা, তবুও এই পদক্ষেপ দেশের আর্থিক খাতে আস্থা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
একটি তুলনামূলক ধারণা:
আমানত সুরক্ষার এই ব্যবস্থা অনেকটা বীমা পলিসির মতো। আপনি যখন আপনার মূল্যবান জিনিস (আমানত) কোনো স্থানে (ব্যাংক/ফাইন্যান্স কোম্পানি) রাখেন, তখন এই অধ্যাদেশটি নিশ্চিত করে যে যদি সেই স্থানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় (বন্ধ বা অবসায়িত হয়), তবে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত (২ লাখ টাকা) ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা আপনি তাৎক্ষণিকভাবে পাবেন। এর মাধ্যমে বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয় থেকে সাধারণ আমানতকারীদের রক্ষা করা সম্ভব হবে।