৯ ফাইন্যান্স কোম্পানি অবসায়নের অনুমোদন: অর্থনীতির শুদ্ধি অভিযান

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা এবং আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থতার পর অবশেষে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক (BB)। ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ৯টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (NBFI) বা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ন (Liquidate) করার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটিকে আর্থিক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শুদ্ধি অভিযানগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে নিয়ন্ত্রকরা এখন ‘ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫’ এবং ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩’ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর আনুষ্ঠানিক অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে।

অবসায়নের তালিকায় থাকা ৯ প্রতিষ্ঠান

এই ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সম্ভাব্য অবসায়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে:

  1. পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (PLFS)
  2. ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস
  3. আভিভা ফাইন্যান্স
  4. এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট
  5. ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট
  6. বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (BIFC)
  7. প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স
  8. জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি
  9. প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড

এই ৯টি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে ‘অব্যবহারযোগ্য’ (unusable) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল বেশ কিছু মূল সূচকের ভিত্তিতে। এর মধ্যে প্রধান তিনটি সূচক হলো: আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ক্রমাগত ব্যর্থতা, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং তীব্র মূলধন ঘাটতি

বিপর্যয়ের ভয়াবহ চিত্র: কেন এই কঠোর সিদ্ধান্ত?

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ২০টিকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে

যে ৯টি প্রতিষ্ঠান অবসায়নের পথে, তারা একাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকেরও বেশি (প্রায় ৫২ শতাংশ) দায় বহন করে। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, অস্বচ্ছ আর্থিক বিবরণী এবং দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফলেই এই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ৯টি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাস্থ্য এতটাই খারাপ যে, সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের দায় পরিশোধ করা প্রায় অসম্ভব।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপির হারের কিছু চিত্র নিম্নরূপ:

  • এফএএস ফাইন্যান্স: মোট ঋণের ৯৯.৯৩ শতাংশই খেলাপি এবং ক্রমপুঞ্জিভূত লোকসান ১,৭১৯ কোটি টাকা।
  • ফারইস্ট ফাইন্যান্স: খেলাপি ঋণ ৯৮ শতাংশ, লোকসান ১,০১৭ কোটি টাকা।
  • বিআইএফসি: খেলাপি ঋণ ৯৭.৩০ শতাংশ, লোকসান ১,৪৮০ কোটি টাকা।
  • ইন্টারন্যাশনাল লিজিং: খেলাপি ঋণ ৯৬ শতাংশ, পুঞ্জিভূত লোকসান ৪,২১৯ কোটি টাকা।
  • পিপলস লিজিং: খেলাপি ঋণ ৯৫ শতাংশ, লোকসান ৪,৬২৮ কোটি টাকা।

আমানতকারীদের জন্য স্বস্তি: সরকারের বিশেষ বরাদ্দ

এই অবসায়নের সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন সাধারণ আমানতকারীরা, যারা বছরের পর বছর ধরে তাদের পরিপক্ব আমানতের অর্থ ফেরত পেতে অপেক্ষা করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিত করেছে যে, আমানতকারীদের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্য অনুযায়ী, লিকুইডেশন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই আমানতকারীদের পাওনা ফেরত দেওয়া হবে। আমানতকারীদের পাওনা মেটানোর জন্য সরকার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার মৌখিক অনুমোদন দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রমতে, সমস্ত লোকসান সমন্বয় এবং পাওনা নিষ্পত্তির জন্য সরকারের প্রাথমিক ব্যয় প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা হতে পারে।

এই ৯টি প্রতিষ্ঠানে আটকে থাকা মোট আমানতের পরিমাণ হলো ১৫ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাহকদের নিট ব্যক্তি আমানতের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা।

আগামীর পথ: তদারকি ও পুনর্গঠন

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পদক্ষেপ আর্থিক খাতে একটি আক্রমণাত্মক হস্তক্ষেপের (aggressive intervention) ইঙ্গিত দেয়। নিয়ন্ত্রকরা এখন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, লিকুইডেটর নিয়োগ, সম্পদ বিক্রি এবং পাওনাদারদের মধ্যে প্রাপ্ত অর্থ বণ্টনের কাজ শুরু করবে।

উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে গত ২২ মে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবসায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হয়।

এই অবসায়নের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে পাঁচটি দুর্বল শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই একীভূতকরণ ও অবসায়ন—উভয় সিদ্ধান্তই স্পষ্ট করে যে আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম আর প্রশ্রয় পাবে না, যা এই খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি ঐতিহাসিক ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

Leave a comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।