অনেক জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে জাতীয় সঞ্চয় স্কিমসমূহের মুনাফার হার পুনঃনির্ধারণপূর্বক খানিকটা যৌক্তিকীকরণ হয়েছে ২১ সেপ্টেম্বরের প্রজ্ঞাপন মারফত । জাতীয় সঞ্চয় স্কিমসমূহের/ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর)। মূলত গত বছর ব্যাংক খাতে সুদ হার ৬%-৯% করার পর থেকেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার নিয়ে আলোচনা -সমালোচনা শুরু হয় ।
Table of Contents
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার
২৩ মে, ২০১৫ তারিখের সর্বশেষ জাতীয় সঞ্চয় স্কিমসমূহের/ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারে বড় পরিবর্তন আনে সরকার সামাজিক সুরক্ষার বিষয় এবং বাজারে প্রচলিত মুনাফা/সুদ বিবেচনায় ঠিক করা হয়েছিল মুনাফার হার ।
এরপর মার্কেটে সুদহার সর্বেোচ্চ ৬% বেঁধে দিলেও সঞ্চয় স্কিমসমূহের/ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারে বড় পরিবর্তন আসেনি । বিত্তবানদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিয়েও সমালোচনা ছিল অনেকদিন ধরেই ।
২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের প্রজ্ঞাপন অনুসারে, ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রের স্কিমে মুনাফার হার আগের মতো রাখা হয়েছে। তবে এর বেশি পরিমাণ স্কিমে মুনাফার হার কমিয়েছে সরকার। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বড় বিনিয়োগকারীদের মুনাফার হার কিছুটা যৌক্তিক পরিমাণে কমানো হয়েছে ।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নতুন করে যারা সঞ্চয়পত্র কিনবেন শুধু তাদের জন্য পরিবর্তিত এই হার কার্যকর হবে।
এ ছাড়া আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সেটি পুনরায় বিনিয়োগ করলে তখন নতুন মুনাফার হার কার্যকর হবে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয়ের জন্যই নতুন এই মুনাফার হার প্রযোজ্য হবে।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র
প্রজ্ঞাপন আরো বলা হয়েছে, পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। তবে, নতুন নিয়মে এই সঞ্চয়পত্রে যারা ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করবেন তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে মুনাফার হার হবে সাড়ে ৯ শতাংশ। তবে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফার হার আগের মতোই থাকবে।
তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক
এ ছাড়া, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। সেটি এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কমিয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মেয়াদ শেষে মুনাফা পাওয়া যাবে ৯ শতাংশ। তবে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফার হার আগের মতোই থাকবে।
পেনশনার সঞ্চয়পত্র
অবসরভোগীদের জন্য নির্ধারিত পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে এত দিন ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যেত। এখন এই সঞ্চয়পত্রে যারা ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করবেন তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে এই হার হবে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফার হার আগের মতোই থাকবে।
পরিবার সঞ্চয়পত্র
পরিবার সঞ্চয়পত্রের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে মুনাফার হার বর্তমানে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে এখন থেকে এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই হার সাড়ে ৯ শতাংশ। ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত এর মুনাফার হার আগের মতোই থাকবে।
ডাকঘর সঞ্চয়পত্র
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সাধারণ হিসাবে মুনাফার হারে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এই স্কিমের মুনাফার হার সাড়ে ৭ শতাংশ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া, ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে তিন বছর মেয়াদি হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তবে নতুন নিয়মে এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে হবে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ।
ওয়েজ আর্নার’স ডেভলপমেন্ট ফান্ড
ওয়েজ আর্নার’স ডেভলপমেন্ট ফান্ডের বর্তমান মুনাফার হার ১১ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে নতুন হারে ১৫ লাখের বেশি বিনিয়োগ করলে মুনাফা মিলবে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। আর ৩০ লাখের বেশি বিনিয়োগে মুনাফা পাওয়া যাবে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ ছাড়া বিনিয়োগ ৫০ লাখের বেশি হলে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ হারে মুনাফা পাওয়া যাবে।
ট্রেজারী বন্ড সম্পর্কে জানতে এখানে ঘুরে আসুন
সঞ্চয়পত্রের প্রতি লাখে প্রাপ্য মুনাফার পরিমাণ
কাদের সুবিধা
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার সমন্বয়ের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান/পক্ষ সুবিধা উপভোগ করবে । নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ
- প্রধান সুবিধাভোগী সরকার, সরকারের সুদ ব্যয় হ্রাস পাবে এই নতুন হার প্রয়োগ হলে ।
- শেয়ার মার্কেট কিছুটা বেশি বিনিয়োগ পাবে এই মুনাফা হার ও বিনিয়োগসীমা বাস্তবায়িত হলে ।
- উদ্যোক্তা ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটোর সম্ভাবনা রয়েছে ।
সমস্যা কাদের জন্য
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার সমন্বয়ের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান/পক্ষ সমস্যার সম্মুখীন হবে । নিচে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলোঃ
- বয়স্করা চিকিৎসা ও বর্ধিত জীবনযাত্রার ব্যয় সামলাতে হিমসিম খাবেন।
- মধ্যবিত্তরা সম্মানজনক জীবনধারণে সমস্যায় পড়বে।
- পেনশনের টাকায় চলতে বাড়তি চাপ আসবে।
- একাধিক আয়ের উৎস নেই এমন মানুষেরা চাপে পড়বেন।
- ঝুকিপূর্ণ বিনিয়োগের মাধ্যমে অনেকেই শেষ সম্বল/মূলধন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবেন।
জেনে রাখা জরুরি
- এখন থেকে মোট ১৫ লক্ষ টাকার অধিক মূল্যের সঞ্চয়পত্র, ওয়েজ আর্নাস ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ডাকঘর সঞ্চয়-মেয়াদী হিসাব এর ক্ষেত্রে কমছে মুনাফার হার। আজকে থেকে চালু হওয়া স্কিমের ক্ষেত্রে এই হার প্রযোজ্য হবে।
- মোট ১৫ লক্ষ টাকার কম মূল্যের উক্ত সঞ্চয় স্কিমসমূহ ক্রয়ের ক্ষেত্রে আগের মুনাফার হার প্রাপ্ত হবেন। অর্থাৎ ১৫ লক্ষ টাকার পর্যন্ত জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের ক্ষেত্রে মুনাফার হার কমানো হয়নি।
- আজকের পূর্বে যে সঞ্চয় স্কিম কেনা হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে পূর্বের রেটের মুনাফা প্রাপ্ত হবেন এবং মেয়াদান্তেও পূর্বের রেটে মুনাফা পাওয়া যাবে।
- গতকাল পর্যন্ত যার ১৫ লক্ষ টাকার সঞ্চয় স্কিম ছিল, তিনি যদি আর কোনো সঞ্চয় স্কিম না কেনেন, তাহলে তিনি ক্রয়কালীন হারে মুনাফা পাবেন। কিন্তু তিনি যদি এরপর যেকোনো এমাউন্টের সঞ্চয় স্কিম কিনেন, তাহলে তার নতুন সব বিনিয়োগের উপর নতুন মুনাফা হার প্রযোজ্য হবে।
- ইতোমধ্যে যাদের ১৫ লক্ষ টাকার উপর সঞ্চয় স্কিম আছে, তারা যদি নতুন করে সঞ্চয় স্কিম না কিনেন, তারাও ক্রয়কালীন হারে মুনাফা পাবেন।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের ইতিহাস
আজকের সঞ্চয় প্রকল্প তথা সঞ্চয়ের অতীত ইতিহাস সর্ম্পকে যতদূর জানা যায়, সঞ্চয় ব্যাংকের জনক হিসেবে খ্যাত রেভারেন্ড হেনরি ডানকান ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে স্কটল্যান্ডের এক গীর্জায় প্রখম সঞ্চয় ব্যাংক স্থাপন করেন। ইংল্যান্ডে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ৬৫ বছর পূর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারিভাবে ‘জাতীয় সঞ্চয় সংস্থা’ আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয় সঞ্চয় সংস্থা ইংল্যান্ডের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। জনগণকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এ উপমহাদেশে ১৯৪৪ সালে ভারতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সর্বপ্রথম ‘জাতীয় সঞ্চয় সংস্থা’ কাজ শুরু করে। এ সংস্থার প্রধান কার্যালয় ভারতের সিমলায় অবস্থিত ছিল।
অতঃপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জাতীয় সঞ্চয়ের কার্যক্রম তদানীন্তন সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানান্তরিত হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তর প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
তারপর র্দীঘ ৪২ বছর পর জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে অধিদপ্তরে উন্নীত হয়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অধিনস্থ একটি অধিদপ্তর।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের উদ্দেশ্যসমূহঃ-
- জনগণকে সঞ্চয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করা;
- বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জাতীয় সঞ্চয় স্কীমের মাধ্যমে আহরণ করা;
- সঞ্চয় স্কীমের মাধ্যমে আহরিত অর্থ দ্বারা জাতীয় বাজেট ঘাটতি পূরণ করা;
- জাতীয় সঞ্চয় স্কীমের মাধ্যমে দেশের বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী যেমন- মহিলা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক,প্রবাসী বাংলাদেশীএবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনয়ন;
- বৈদেশিক নির্ভরতা হ্রাস এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করা ইত্যাদি।